themesdealer
domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init
action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/notunalo/public_html/wp-includes/functions.php on line 6114পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে দু’টি ম্যুরাল ও ম্যুরালের জন্য কিছু স্থাপনা নির্মাণেই ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ম্যুরাল নির্মাতা ও স্থপতিরা বলছেন, এত টাকা ব্যয় একেবারেই অস্বাভাবিক।
পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ম্যুরাল নির্মাণের জন্য কোনো দরপত্র ডাকা হয়নি। অন্যতম ঠিকাদার ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে বালিশ-কাণ্ডে বিতর্কিত মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
শুধু ম্যুরাল নির্মাণ নয়, অস্বাভাবিক ব্যয় করা হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও। সেখানে ব্যয় করা হয়েছে ৮৯ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রেও উন্মুক্ত দরপত্র নয়, ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে নিজেদের পছন্দমতো।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে ম্যুরাল দু’টি নির্মাণে ৫০ কোটি টাকাও লাগত না। ম্যুরালে ব্যবহার করা নির্মাণসামগ্রীর দু-তিন গুণ দাম ধরে ঠিকাদার বিল তুলে নিয়েছেন।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তড়িঘড়ি করে দুই প্রান্তে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়। ম্যুরাল সেতুটির প্রকল্প প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ম্যুরাল ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনার নাম দেওয়া হয়েছিল ইনোগ্রেশন বা উদ্বোধনী কমপ্লেক্স।
চূড়ান্ত বিলের নথি অনুসারে, উদ্বোধনী কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়ন ও তদারকি বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা। মাওয়া ও জাজিরায় ভূমি উন্নয়ন ও পাইলিং বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনী কমপ্লেক্স নির্মাণ, বৈদ্যুতিক কাজ, ফোয়ারা নির্মাণ ও শিল্পকর্ম বাবদ খরচ হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা। একই কাজ জাজিরায় করতে ব্যয় হয়েছে ৪২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে দুই প্রান্তের উদ্বোধনী কমপ্লেক্স তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। উদ্বোধনী এই কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে মূলত ম্যুরালকে কেন্দ্র করে।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুই প্রান্তে দু’টি উদ্বোধনী কমপ্লেক্সে একটি করে ম্যুরাল ও উদ্বোধনের ফলক রয়েছে। এর চারপাশে নির্মাণ করা হয়েছে বেদি। সামনে আছে ফোয়ারা। মাওয়া প্রান্তে কয়েকটি ও জাজিরায় একটি ইস্পাতের তৈরি মাছের ভাস্কর্য রয়েছে। মাওয়া প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ম্যুরালের উচ্চতা ৯০ ফুট ও প্রস্থ ৪৫ ফুট। জাজিরা প্রান্তে ম্যুরালের উচ্চতা ৭২ ফুট ও প্রস্থ ৩৬ ফুট। ম্যুরাল দু’টি মোট ৬ হাজার ৬৪২ বর্গফুটের।
ম্যুরাল দু’টির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের অংশ থেকে। সেতু বিভাগ সূত্রের দাবি, তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্সকে ম্যুরাল নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে রয়েছেন।
গত বুধবার মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ হোসেন বলেন, তিনি মাওয়া উদ্বোধনী কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ করেছেন। তার সঙ্গে ৫২ কোটি টাকার চুক্তি ছিল। ম্যুরাল নির্মাণে আরও কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
আসিফ হোসেন আরও বলেন, চাপের মুখে ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। ৯ মাসের কাজ আড়াই মাসে শেষ করেছেন। বেশি ব্যয়ের বিষয়টি ঠিক নয়।
মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘বালিশ-কাণ্ড’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের ছাদধসের ঘটনায় আলোচিত। ২০১৯ সালে রূপপুর প্রকল্পে আবাসিক ভবনের জন্য ‘অস্বাভাবিক’ দামে বালিশ কেনার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তখন ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিলেন মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ হোসেন। ওই কাজের অন্যতম ঠিকাদার ছিল মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। এতে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয় ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। একেকটি বালিশ ভবনে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছিল ৭৬০ টাকা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ১০ তলাবিশিষ্ট শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হলের একাংশ গত ৩০ জানুয়ারি ধসে পড়ে। এই কাজের ঠিকাদারও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন।
এদিকে, ম্যুরাল নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা সেতু বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী বলেন, যেখানে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি ছিল নিচু। মাটি ভরাট ও পাইলিং করতে হয়েছে। এ জন্য ব্যয় বেশি।
বিতর্কিত ঠিকাদার নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে গেলে কাজটি ছয় মাস পিছিয়ে যেত। উদ্বোধনের তাড়াহুড়ার মধ্যে ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য তাড়াহুড়ার নামে জনগণের টাকা অযৌক্তিকভাবে খরচের কোনো সুযোগ নেই। উন্মুক্ত দরপত্র করা হলে খরচ অনেক কম হওয়ার সুযোগ ছিল বলে মনে করেন অনেকে।
ম্যুরাল ও অন্যান্য স্থাপনার কাজ চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। মাটি ভরাট, নকশা, স্থাপনা নির্মাণ ও ম্যুরাল তৈরি। দেখা গেছে, নকশা ও ম্যুরাল নির্মাণ বাবদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা মোট ব্যয়ের সামান্য অংশ। নকশাকারী পেয়েছেন ৯৫ লাখ টাকা। ম্যুরাল শিল্পী জানিয়েছেন, তিনি প্রতি বর্গফুটে পেয়েছেন দুই হাজার টাকা। হিসাব করে দেখা যায়, এতে ব্যয় দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
ম্যুরালসহ উদ্বোধনী কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তদারক করেন স্থপতি ফজলে করিম শিশির। তিনি বলেন, তাদের নকশায় নদীতীরে সৌন্দর্যবর্ধনসহ আরও অনেক কিছু ছিল। সময় স্বল্পতার জন্য কাজ কমানো হয়েছে। তিনি জানান, পদ্মা সেতুর দুই পারে উদ্বোধনী কমপ্লেক্সের জন্য ছয় লাখ বর্গফুট জায়গা পাকা করা হয়েছে।
জাজিরা প্রান্তে ম্যুরাল তৈরির কাজ করেছে নক্ষত্র নামের ভাস্কর্য ও মৃৎশিল্প খাতের একটি প্রতিষ্ঠান। শিল্পী আশরাফুল আলম ও মো. অহিদুজ্জামান সিরামিকের টুকরা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পুড়িয়ে রং টুকরা টুকরা করে ম্যুরাল তৈরি করেন।
আশরাফুল আলম বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতি বর্গফুটের জন্য তারা দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন।
ম্যুরাল নির্মাণে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় কতটা যৌক্তিক, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল খ্যাতিমান শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সহসভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নাকীর কাছে। তারা দু’জনই ব্যয়ের পরিমাণকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন।