কলকাতার আরজিকর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় উত্তাল গোটা পশ্চিমবঙ্গ। এই ঘটনার ন্যায় বিচার চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন নাগরিক সমাজ, চিকিৎসক সমাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতারা।
‘দফা এক দাবী এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’- এই দাবি নিয়ে নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল বিজেপি। এছাড়া রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আবার পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজার অভিযানের ডাক দিয়েছিল জুনিয়র ডাক্তাররা।
এমন এক পরিস্থিতিতে একদিন আগেই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক আইএএস কর্মকর্তা জহর সরকার। শুধু তাই নয় মমতা ব্যানার্জিকে দুই পাতার চিঠি লিখে তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন ‘আমার এত বছরের জীবনে এমন ক্ষোভ ও সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থা আগে কখনো দেখেনি।’
এই ইস্যুতেই বিরোধী দল কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী আবার রাজ্য সরকারকে গন্ডারের চামড়ার সাথে তুলনা করে কটাক্ষ করে বলেছেন ‘এই সরকারের চামড়া এতটাই মোটা যে, কোন আঘাত, মান, অপমান স্পর্শ করছে না।’
কেউ কেউ আবার এই আন্দোলনকে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সাথে তুলনা টেনেছেন। কিন্তু এরাজ্যে যে সেই পরিস্থিতি একেবারেই সম্ভব নয়, তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিজেও নন, এমনকি এই মুহূর্তে বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিবর্তে রাজ্যের মানুষকে আসন্ন দুর্গাপূজা উৎসবে মেতে ওঠার আহ্বান জানালেন মমতা।
আজ সোমবার রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নে সংবাদ সম্মেলন করে বিরোধীদের নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী জানান ‘সারা পৃথিবীতে বাংলার নামে বদনাম করা হচ্ছে। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ হয়েছে যারা এখান থেকে পড়াশোনা করে, খেয়ে দেয়ে, মানুষ হয়ে বাইরে গেছেন। তারা গিয়ে একতরফা ভাবে বাংলার বদনাম করছে। তারা তো দুই তরফের কথা শুনতে পাচ্ছেন না। তাদের বোঝা উচিত যে বাংলাদেশের পরে আপনারা এই সুযোগটা নিচ্ছেন তো? বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র। আমরা তাদের ভালোবাসি, সম্মান করি। ভাষাকে সম্মান করি। ভারত আলাদা রাষ্ট্র। আপনারা এই দুটো বিষয় মাথায় রাখতে ভুলে গেছেন। এখানে বাংলাদেশ হবে না। কারণ বাংলাদেশেই বাংলাদেশ হয়। বাংলাদেশটা একটা অন্য রাষ্ট্র তাদের আমরা ভালবাসি সম্মান করি। আমরা একই ভাষায় কথা বলি।’
অন্যদিকে বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘সাত দিন আগে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদত্যাগ করার জন্য আমার কাছে নিজে এসেছিলেন। কিন্তু সামনে পুজো। আইনশৃঙ্খলা একটা বিষয়টা বড় বিষয়। যিনি দায়িত্বে থাকবেন তাকে তো বিষয়টা জানতে হবে। এখন পুজোর সময়, কিছুদিন ধৈর্য ধরলে কি হয়? আপনারা ঠিক করবেন সবাইকে বদলাতে হবে? আপনি ১০ টা দাবি দিতে পারেন। আমি ৫ টা দাবি করতে পারি, ৫টা নাও করতে পারি।’
একসময় মমতা বলেন ‘দুর্গাপুজো আমাদের সেরা উৎসব। এই উৎসবে যেন কোন ভুল-ভ্রান্তি, কুৎসা, অপপ্রচার, চক্রান্ত না হয়। আপনারা পূজায় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন। এক মাস একদিন হয়ে গেল। রোজ রোজ রাস্তায় নামলে অনেক মানুষের অসুবিধা হয়।’
গত ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালে ওই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে জুনিয়র ডাক্তাররা। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সোমবার ভারতের শীর্ষ আদালতে এ সম্পর্কিত মামলার শুনানি ছিল। এই মামলার পরবর্তী শুনানি ১৭ সেপ্টেম্বর। শুনানিতে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরানোর আবেদন জানিয়েছে আদালত।
এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘সিবিআইকে বলব তাড়াতাড়ি বিচারের ব্যবস্থা করুন। ফার্স্ট ট্রাক কোর্টে বিচার করে যে নির্যাতিতা, তার পরিবারকে তাড়াতাড়ি বিচার দিন। কারণ এটা তো এখন আপনাদের হাতে নেই। সাজা দেওয়ার ব্যাপারটা এখন সিবিআই এর হাতে।’
মুখ্যমন্ত্রীর অভিমত ‘বাংলায় একটা ঘটনা ঘটলো সেটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা একটা লোকও তাকে সমর্থন করি না। আমরা চুপচাপ আছি, নীরবে বেদনা সহ্য করছি। পুলিশকে পদক্ষেপ নিতে বারণ করেছি কিন্তু দয়া করে পরিষেবাটা দিন।’ তার দাবি ‘ইতিমধ্যে ৭ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমি অনুরোধ করবো ডাক্তাররা যেন কাজে ফেরেন।’ স্বাস্থ্য সচিবকে নির্দেশ দেন, পরিষেবা না পেয়ে যাতে কোন মানুষ মারা না যায় সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে।
মমতার প্রশ্ন কেউ কেউ অভিযোগ করছে তথ্য প্রমাণ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি তথ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করব কেন! কাকে বাঁচাতে যাব? কেউ আমাদের বন্ধু নয়, কেউ আমাদের শত্রু নয়। আইন আইনের পথে চলবে। অনেকে উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছে। আমি যখন একটা চেয়ারে কাজ করি তখন চেয়ারটাকে সম্মান করতে জানি। অনেক অসম্মান, অপমান করেছেন।’
এদিকে নবান্ন থেকে সংবাদ সম্মেলন করে রাজ্যের মানুষকে উৎসবে ফেরার যে আহ্বান মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন, তা নিয়ে নির্যাতিতা ছাত্রীর মা জানান ‘আমার কাছে এটা অমানবিক মনে হচ্ছে, কারণ আমি তো মেয়ের মা। আমি তো সন্তান হারিয়েছি, তাই আমার অমানবিক মনে হচ্ছে।’
তিনি ফের বলেন ‘গোটা দেশের মানুষ যদি ভাবে উৎসবে ফিরবে তাহলে তারা ফিরতেই পারে। কিন্তু তারা আমার মেয়েকে নিজের পরিবারের সদস্য বলে মনে করছেন। তারা যদি উৎসবে ফিরতে পারেন আমার কিছু বলার নেই। আমার বাড়িতেও দুর্গাপুজো হতো, মেয়ে ঘরে করত। কিন্তু আমার বাড়িতে আর কোনদিন দুর্গাপুজোর আলো জ্বলবে না। আমার ঘরের বাতি নিভে গেছে। আমি কি করে মানুষকে বলবো উৎসবে ফিরতে?’ মায়ের প্রশ্ন ‘মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারে যদি এমন ঘটনা ঘটত তাহলে কি উনি একথা বলতে পারতেন?’
নির্যাতিতা মায়ের অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী এই আন্দোলনকে গলা টিপে হত্যা করতে চাইছেন। তিনি বলেন ‘আমার মেয়েকে যেভাবে গলা টিপে মারা হয়েছে, প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে মমতা ব্যানার্জিও আন্দোলনের গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছেন। কারণ, আন্দোলনটা থেমে গেলে উনি নিজের জায়গায় ভালোভাবে টিকে থাকতে পারবেন।’
তার হুঁশিয়ারি ‘..কিন্তু যতদিন না বিচার পাবো ততদিন আমরা পথে থাকবো, আন্দোলনে থাকবো।’