ভ্যাদা মাছের ক্যাদা খাওয়ার রাজনীতি

Reporter Name / ৪ Time View
Update : রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫

আমি বাপু গ্রামবাংলায় জন্ম নেওয়া মানুষ। কলকাতার শান্তিপুরী বাংলা কিংবা বিলেতের ইংরেজি আমার একদম ধাতে সয় না। আমার স্বল্প-খাদ্যাভ্যাস এবং কথাবার্তায় যেমন গোয়া গেয়ো ভাব রয়েছে তদ্রুপ সময়ের বিবর্তনে জীবনজীবিকা, রাজনীতি অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে যা কিছু শিখেছি সেখানেও গ্রামীণ পরিবেশ-প্রতিবেশ বিশেষত আবহমান বাংলার সত্তর দশকের প্রকৃতি ও পরিবেশ সব সময় আমার চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

রাজনীতি করতে গিয়ে বহু হাতি-ঘোড়ায় চলেছি, রাজা- বাদশাহ, আমির-ওমরাহ দেখেছি এবং পোলাও-কোর্মা কালিয়া-কোপ্তায় ভরপুর শাহি খানাপিনার বহু মাহফিলে হাজির হয়েও ওসবে মগ্ন না হয়ে ডাল দিয়ে ডাঁটার চচ্চরি, সরিষা দিয়ে কচুর লতি এবং শজনে দিয়ে রান্না করা পাতলা ডালের সঙ্গে দেশি কই বা মাগুর মাছের ঝোলের স্বপ্নে শাহি খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। লন্ডন, আমেরিকা, দিল্লি, টোকিও, বেইজিং কিংবা সিউলের মতো কসমোপলিটান শহরের পাঁচ তারকা হোটেলে বসেও ফরিদপুর জেলার সদরপুরের শামপুর গ্রামের ভ্যাদ ভ্যাদা এঁটেল মাটির মমত্ব অনুভব করেছি।

ফলে বদলে যাওয়া সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাকে কোনো দিন প্রভাবিত করেনি। উল্টো বিত্তবৈভব ক্ষমতার প্রচণ্ড দাপটের যন্ত্রণায় অস্থির না হয়ে ফিরে গিয়েছি বালক বেলায় সেই বর্ষাকালের অনবরত বৃষ্টি এবং পানিতে টইটম্বুর , নদ-নদী-ফসলি মাঠ, পুকুর নালার অপরূপ প্রশান্তির সেসব দিনের স্মৃতির মন্থনে। আমাদের গ্রামবাংলায় রয়না নামে পরিচিত মাছটির জন্য আমার ভীষণ মায়া হতো। শহরে এসে শুনেছি রয়নাকে কেউ কেউ মেনি মাছ বললেও বেশির ভাগ মানুষ ওটিকে ভ্যাদা মাছ বলে। মাছগুলো একেবারেই বোকাসোকা। মাটি কামড়ে থাকে এবং খাবার মতো কিছু না পেলে কাদা খেয়ে বেঁচে থাকে। অন্যান্য মাছের মতো ওগুলো সাঁতার কাটা, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ করে না। নদ-নদীতে নতুন পানি এলে ভ্যাদা মাছ অন্য মাছের মতো লাফালাফি করে না। বরং সর্বদা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। ফলে যেসব মাছ শিকারি আমাদের জমানায় ডুব দিয়ে কাদা হাতিয়ে মাছ শিকার করতেন তারা অন্য কোনো মাছ না পেলেও ভ্যাদা মাছ শিকার করে বীরদর্পে বাড়ি ফিরতেন।

আপনারা যারা ভ্যাদা মাছ চেনেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে মাছটির হাঁ করার ক্ষমতা অস্বাভাবিক। কুমির, জলহস্তী কিংবা অজগর সাপের মতো প্রাণীরা যেভাবে নিজেদের শরীরের মতো আবহমান বাংলাসমআকৃতির প্রাণীকে গিলে খেতে পারে তদ্রুপ ভ্যাদা মাছ তার দুর্বল শরীর নিয়ে কাদার মধ্যে লুকিয়ে থেকে সুযোগের অপেক্ষায় হাঁ করে থাকে এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র যে কোনো মাছ এমনকি তার চেয়ে আকারে বড় হলেও তা শিকার করে ফেলে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো- কেবল বৃহৎ হাঁ করার শক্তি এবং কাদার মধ্যে লুকিয়ে থেকে অন্য মাছের নির্বিকার চলাফেরা ও অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে গপাগপ শিকার ধরা এবং শিকারকৃত মাছ গিলে ফেলার ক্ষমতার কারণে ট্যাংরা-কই-শিং-মাগুরের মতো শক্তিশালী মাছগুলোর কবর রচনা হয় ভ্যাদা মাছের পেটের ভিতরে।

ভ্যাদা মাছের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির কী সম্পর্ক তা নিয়ে আলোচনার আগে মাছটির দৈহিক গঠন, চরিত্র এবং পরিণতি নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। জলাভূমির অন্য মাছ বা কীটপতঙ্গের মতো জীবনযুদ্ধে সময় ব্যয় না করে ভ্যাদা মাছ কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ফলে তার শরীর দুর্বল-মেরুদণ্ডের হাড় নরম এবং মাংসপেশি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও প্রাণীটির তিনটি অঙ্গ অতিশয় শক্তিশালী। প্রথমত. ফুসফুস। দিনের পর দিন ডুব দিয়ে থাকার পরও ভ্যাদা মাছের শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা হয় না। শক্তিশালী ফুসফুসের কারণে পানির মধ্যে মিশ্রিত সীমিত অক্সিজেন থেকেই সে তার প্রাণবায়ু সংগ্রহ করে। মাছটির চোয়াল এবং দৃষ্টিশক্তি অস্বাভাবিক শক্তিশালী। শিকারের আশায় সারাক্ষণ হাঁ করে থাকতে গিয়ে এবং সারাক্ষণ চোখ খোলা রাখতে গিয়ে চোখ ও চোয়ালে সে যে শক্তি সঞ্চয় করে তা শিকারকে বাগে পেয়ে কীভাবে কাজে লাগায় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারে।

জলাশয়ের ভ্যাদা মাছের খপ্পরে পড়ে অন্যান্য মাছের কী দশা হয় তা আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। কারণ আমরা একদিকে যেমন মাছের ভাষা বুঝি না অথবা মৎস্য সমাজের কোর্ট-কাচারি উকিল-মোক্তারের বয়ানও জানি না। আমরা কেবল ভ্যাদা মাছের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের আচরণ কর্ম এবং শিকারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফোক-ফ্যান্টাসির চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারি। আপনারা যারা বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের জুলুম-অত্যাচার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তারা নিশ্চয়ই জানেন ওই সময়ে বড় বড় রুই-কাতলা-বোয়াল পাঙাশ-আইড়রূপী রথী-মহারথীরা কীভাবে ভ্যাদা মাছ হয়ে কাদার মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিকার ধরার জন্য ভ্যাদা মাছের মতো হাঁ করে থাকতে গিয়ে নিজেদের চোয়াল-গলা-পাকস্থলী কতটা শক্তিশালী করেছেন সে কথা বলার আগে শেখ হাসিনার জমানায় ভয়-আতঙ্কে রুই-কাতলারা কীভাবে কাদায় লুকাতেন তার একটি বাস্তব ও সত্য ঘটনা বর্ণনা করে নিই।

ঘটনার দিন বিকালে আমি অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের অফিস ভবনের সামনের ফুটপাতে মস্তবড় এক রুই-কাতলাকে বিরস বদনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। নেতা-কর্মীহীন নিঃসঙ্গ রুই-কাতলাকে আমি কোনো দিন অতটা বিষণ্ন-বিমর্ষ এবং মিসকিন অবস্থায় দেখিনি। মলিন বস্ত্র উসকো-খুশকো চুল এবং চেহারা সুরতে ভয়-আতঙ্ক ও অপমানের দগদগে ঘা দেখতে পেয়ে আমি সহানুভূতি জানানোর জন্য এগিয়ে গেলাম এবং ভদ্রলোকের কাঁধে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- কী হয়েছে ভাই? উত্তরে তিনি যা বললেন তা শুনে প্রথমে আমার চক্ষু চড়কগাছ হলো এবং পরক্ষণে আমারও মনটা ভারী হয়ে গেল। তিনি জানালেন যে, গত রাত থেকে এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারেননি- অজানা শঙ্কা এবং অপমানে সারা শরীর কাঁপছে। নিজের অস্তিত্বের ওপর ঘৃণা ধরে গেছে- মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। আমার পাল্টা প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন- গত রাতে আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের অফিস পুলিশ ঘেরাও করেছিল। পালানোর কোনো পথ না পেয়ে আমি দৌড়ে ছাদে উঠলাম এবং কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে পানির ট্যাংকের মধ্যে ঢুকে কোনোমতে নাকটি বাঁচিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। পুলিশ পুরো ভবন তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে ছাদে এলো এবং সবকিছু লন্ডভন্ড করে হাঁকডাক দিয়ে আমাকে খুঁজতে থাকল এবং না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় একজন পুলিশ বলল- পানির ট্যাংক তো চেক করা হলো না। অন্য পুলিশ বলল, রুই-কাতলা অতিশয় সাহসী মানুষ। মরে গেলেও পানির ট্যাংকে পালাবে না। পুলিশের কথা শুনে আমি আল্লাহর কাছে হাত পাতলাম। বললাম- ওহে দয়াময়। আমাকে মেরে ফেলো। কিন্তু ওই অবস্থায় বেইজ্জতি করো না। আমার দোয়া কবুল হলো। পুলিশ চলে গেল কিন্তু সেই ঘটনা মনে করে আমি গত রাত থেকে একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে মরে গেলেই ভালো হতো।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri