বাংলাদেশ-চীন নতুন দিগন্তে

Reporter Name / ১৭৫ Time View
Update : শুক্রবার, ২৮ মার্চ, ২০২৫

বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতার পথে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক। গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়ন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাণিজ্যে ভারসাম্য আনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে চীনের সহযোগিতা কামনা করেন অধ্যাপক ইউনূস। প্রতিটি বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক মনোভাব পোষণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি অন্তত ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান নিশ্চিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে ড. ইউনূস ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া চীনের বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে যে হৃদ্যতা ছিল, তা অকল্পনীয়। অধ্যাপক ইউনূসকে কতটা উঁচুস্তরের নেতা হিসেবে উনারা দেখছেন তা তাঁদের আন্তরিকতায় স্পষ্ট। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁরা অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়তে চান। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিষয়গুলো বলেছেন। যেসব ইস্যুতে আমরা চীনের সমর্থন চাচ্ছি সেগুলো বলেছেন। প্রতিটি বিষয় চীনা প্রেসিডেন্ট ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। উনি বলেছেন অধ্যাপক ইউনূসের সরকারকে তাঁরা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন। অধ্যাপক ইউনূস চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। শি জিনপিং বলেছেন, এ ব্যাপারে তিনি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবেন। আমরা আশা করছি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় যাবে। তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে আমরা চীনাদের জন্য একটি ইকোনমিক জোন করার কথা বলে আসছি। সেটা এগোয়নি। এ সরকার আসার পর দ্রুত কাজ এগোচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট যখন উৎসাহিত করার কথা বলেছেন, আশা করছি চায়নিজ বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করবেন।

ঢাকা-বেইজিং ৯ চুক্তি স্বাক্ষর : বাংলাদেশ ও চীন অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং ক্লাসিক সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, বিনিয়োগসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল শুরুর ঘোষণা, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং হৃদরোগ সার্জারি যানবাহন দানের বিষয়ে পাঁচটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি : অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় চীন সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ প্রদানের পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণসহায়তা হিসেবে আসবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, এ সফর বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এদিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় অধ্যাপক ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বাংলাদেশে চীনা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের জন্য ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট শি নিশ্চিত করেন, চীনা কোম্পানিগুলোকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বাংলাদেশে স্থানান্তরের জন্য তিনি উৎসাহিত করবেন। আশিক চৌধুরী বলেন, এ সফর অনেক চীনা কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান : গতকাল অধ্যাপক ইউনূস এবং আশিক চৌধুরী বেইজিংয়ে বিশ্বের কিছু বৃহৎ চীনা কোম্পানিসহ ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা তিনটি ইন্টার‌্যাকটিভ সেশনে বক্তব্য দেন। চীনা বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের ব্যবসার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ এমন একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে যেখানে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রসহ বড় বড় নদী প্রবাহিত। বঙ্গোপসাগরের কথা উল্লেখ করে তিনি বাণিজ্য ও ব্যবসা সম্প্রসারণে সমুদ্রের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বাস করে। যার বেশির ভাগই যুবক। যারা উদ্যম, সৃজনশীলতা ও উচ্চাকাক্সক্ষায় পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের এ তরুণ জনগোষ্ঠীর অব্যবহৃত সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। চীনা ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে বিশেষ করে উন্নত টেক্সটাইল, ওষুধশিল্প, হালকা প্রকৌশল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলে জানান বিডা চেয়ারম্যান।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনের জোরালো ভূমিকা চাইলেন ড. ইউনূস : বাংলাদেশ ও চীনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। চীনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক ও সামাজিক ব্যবসার প্রচলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বৈঠকের সময় তিনি রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে আলোচনা করেন এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনে চীনের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

পানি ব্যবস্থাপনায় মাস্টারপ্ল্যান চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা : শত শত বিস্তৃত নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বেইজিংয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে চীনের পানিসম্পদ মন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিনি চীনকে পানি ব্যবস্থাপনার মাস্টার হিসেবে অভিহিত করেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পানি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করার আহ্বান জানান। চীনের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চীন পানি সমস্যার সমাধানে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। পানি নিয়ে বাংলাদেশেরও একই সমস্যা। এ ব্যাপারে চীন তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। চীনের পানিসম্পদ মন্ত্রী স্বীকার করেন চীন ও বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনায় একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তিনি বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল বেশ সুস্বাদু -শি জিনপিং : বাংলাদেশের আম ও কাঁঠালের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গতকাল সকালে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের আম ও কাঁঠাল তিনি খেয়েছেন। ফল দুটি বেশ সুস্বাদু।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri error code: 523
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri error code: 523