ভয়ংকর প্রতারণায় ভোক্তারা

Reporter Name / ৬৫০ Time View
Update : বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বিপণন কার্যক্রমের নামে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ডাক্তার, মেডিক্যাল প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করছে। অথচ ওষুধের গুণগত মান ও কার্যকারিতা নিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করছে না। ফলে সচেতনতার অভাবে ক্রেতারা ওষুধ সম্পর্কে অন্ধকারে থাকছেন। ওষুধ কিনে ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হলেও তাদের কোনো প্রতিকার পাওয়ার পথ নেই। ওষুধ কোম্পানি প্রভাবিত ডাক্তারদের ওপরই তাদের শতভাগ নির্ভর করতে হচ্ছে। বিভিন্ন অসুখে মানুষ পুরনো প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ কিনে বিপদে পড়ছেন। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো অনৈতিক মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে ডাক্তারদের ফ্রিজ, টিভি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, বিদেশ ভ্রমণ, নগদ টাকা দিয়ে পুরো ওষুধ বাজারকে প্রভাবিত করছে। এই অরাজকতা বন্ধে প্রতিটি ওষুধের গুণতম মান ও কার্যকারিতা নিয়ে জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারণা প্রয়োজন, যাতে মানুষ যেন নিজের বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জেনে বুঝে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করতে পারেন। কারণ, ওষুধ কোম্পানি প্রভাবিত ডাক্তাররা রোগীদের সচেতনতার অভাবে ইচ্ছেমাফিক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন ভারী করছেন। এতে ওষুধ কোম্পানির অনৈতিক মুনাফা এবং ডাক্তারদের রোজগার বাড়লেও কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

দেশে ওষুধ শিল্পের বিজ্ঞাপন প্রচারে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো কোম্পানি তার নতুন ওষুধ কিংবা চিকিৎসাপণ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে জানাতে পারে না। বিশ্ববাজারে প্রসিদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতায় ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বিধিমালা সংশোধন করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ করে দিতে বলেছেন তারা।

ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রাসি বাণিজ্যিক তৎপরতার কারণে দেশে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ’ নামে লাখো মানুষের একটি পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তাদের তৎপরতায় মানহীন অপ্রয়োজনীয় ওষুধ রোগীর প্রেসক্রিপশনে ঠাঁই পেয়ে যায়। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫৮ ভাগ কর্মীই ওষুধের বাজারজাতকরণ (মার্কেটিং) ও বিতরণে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের ২৯ ভাগেরও বেশি ব্যয় হয় বিপুল সংখ্যক এ কর্মীর পেছনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো সিনিয়র ডাক্তারদের টার্গেট করে উপহার-উপঢৌকন দেয়। তাদের অনুসরণ করে ঘুষ নেওয়া শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররাও। বিনিময়ে ডাক্তাররা রোগীর প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওই কোম্পানির ওষুধ বেশি করে লেখেন। ডাক্তারদের মনিটরিং করে কোম্পানির লোকজন; তারা প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। ওষুধ কোম্পানিগুলো সেই ঘুষের টাকা উসুল করে ওষুধের দাম বাড়িয়ে।’ সচেতনতার অভাবে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে যা লিখে দেন সেটাই তারা অব্যর্থ ওষুধ হিসাবে কিনে সেবন করেন। ওষুধ সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতা থাকলে এই বাহুল্য সহজেই এড়ানো যায়।

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছে, দেশে ওষুধের বিপণন বাবদ টার্নওভারের ২৯ শতাংশের বেশি খরচ করছে কোম্পানিগুলো। দেশে ওষুধের বাজারের আকার এরই মধ্যে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে শুধু বিপণন বাবদ ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু এই বিপণন প্রক্রিয়াটি খুবই অস্বচ্ছ। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রধানত ডাক্তারদের উপঢৌকন হিসেবে এই ৬ হাজার কোটি টাকার বেশির ভাগ ব্যয় করে। এ জন্য গত তিন-চার দশক ধরে দেশে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ (এমআর) নামে একটি নতুন পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের গেটে, ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে এসব প্রতিনিধি নিয়মিত জড়ো হন। ডাক্তারদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখান রোগীর প্রেসক্রিপশনে। বিনিময়ে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানি থেকে পান নানা সুবিধা। প্রকারান্তরে অনেক ডাক্তারই এখন ওষুধ কোম্পানির বিজ্ঞাপনদাতা। ফলে ওষুধের ক্রেতা জানতে পারছে না ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধও বিপণন কৌশলে ‘বাজার’ পেয়ে যাচ্ছে। ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, সংবাদ মাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধিনিষেধ থাকায় এ কৌশল অবলম্বন করছে তারা। কারণ, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রচারমাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় ওষুধের বিজ্ঞাপন বাবদ বিপুল অঙ্কের এ অর্থ ব্যয় কোথায়, কীভাবে খরচ হয় সে প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ডাক্তারদের তুষ্ট রাখতেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এই প্রক্রিয়াটি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত কোম্পানির নিয়োগকৃত মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের (এমআর) মাধ্যমে ডাক্তারদের বাসায় উপহার সামগ্রীটি পৌঁছে দেয় ওষুধ কোম্পানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ওষুধ বিপণন একটি নিয়মের মধ্যে এলেও দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানির টাকায় চিকিৎসকদের বিদেশ ভ্রমণ বা উপঢৌকন নেওয়ার মতো অনৈতিক চর্চাগুলো তদারকির মধ্যে নেই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri
deneme bonusu veren siteler - canlı bahis siteleri - casino siteleri casino siteleri deneme bonusu veren siteler canlı casino siteleri