ইনসাফ! অর্থাৎ ন্যায় বিচার চেয়ে ফের কলকাতার রাজপথে মানুষের ঢল। সুবিচারের আশায় ফের রাত জাগলেন চিকিৎসক, শিল্পী সমাজ, নাগরিক সমাজ।
গত ৯ আগস্ট কলকাতার আরজিকর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় এক ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে গত এক মাস ধরে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন চলে আসছে। প্রতিবাদের সেই ঢেউ আঁছড়ে পড়েছে গোটা দেশে। আন্দোলনে নেমেছেন চিকিৎসকরাও। কিন্তু ওই ঘটনার এক মাস পূর্ণ হলেও এখনও সুবিচার মেলেনি। ফলে নৃশংস ওই ঘটনার ন্যায় বিচার চেয়ে রবিবার পথে নামে গোটা রাজ্যের মানুষ।
এদিন ভোরের আলো ফুটতেই রাস্তায় নেমে পড়েন অসংখ্য মানুষ। চিকিৎসকরা তো ছিলেনই! হাতে হাত মিলিয়ে কর্মসূচিতে সামিল হলেন শিল্পী, কলাকুশলী, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী প্রত্যেকেই। কোথাও গান, কবিতা, পথ নাটিকা, মানববন্ধন, কোথাও আবার কালো বেলুন উড়িয়ে প্রতিবাদ।
এদিন দুপুরে গড়িয়াহাট, মানববন্ধনে সামিল হন প্রায় ৫২ টি স্কুলের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে যোগ দেন বিভিন্ন পেশার সেলিব্রিটিরাও। জাতীয় পতাকা, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মানববন্ধনে শামিল হন। রাসবিহারীতে প্রতিবাদী মিছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। একসময় গরিয়াহাট, রাসবিহারী কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা হতেই সকলের হাতে জ্বলে ওঠে মোবাইল ফোনের টর্চ, মশাল। সেইসঙ্গে স্লোগান ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। কখনো আন্দোলনকারীদের গলায় শোনা যায়, ইথুন বাবুর লেখা ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’, কেউ আবার স্লোগান তোলেন ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’, আমার মেয়ের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ’।
কলকাতার কুমোরটুলিতে ছবি এঁকে, মূর্তি তৈরি করে প্রতিবাদে সামিল হন মৃৎশিল্পীরা। ধর্মতলায় কালো বেলুন উড়িয়ে প্রতিবাদ। বিকালে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত মিছিল করেন টালিগঞ্জের শিল্পীরা। কলকাতার সিমলা স্ট্রিটে অবস্থিত বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত হাতে মশাল, প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলে শামিল হন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সেই মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন নারীরা।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নাটাগড়ে নির্যাতিতার বাড়ির সামনে থেকে এক দীর্ঘ মানববন্ধন শুরু হয়। হাতে হাত ধরে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে কলকাতার শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে সেই মানববন্ধন পৌঁছায়। ছোট্ট সন্তানকে কোলে নিয়ে যেমন মা-বাবাকে দেখা গিয়েছে সেই মানববন্ধনে অংশ নিতে তেমনি বয়সের বাধা উপেক্ষা করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও সামিল হয়েছেন। তরুণদের সাথেই গলা মিলিয়ে বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন তারা। স্লোগান উঠে ‘বিচার চাইতে লড়াই করো আরজিকরের মাথা ধরো,’ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে, পথে এসে লড়তে হবে।
মানববন্ধনের শামিল হওয়া আন্দোলনকারীরা জানান ‘আমাদের আর কিছু লাগবে না। ধর্ষকদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত এই প্রতিবাদ, লড়াই চলবেই। আমাদের পাড়ার মেয়ের সাথে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা এটা চাই না।’ অনেকে আবার শীর্ষ আদালতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
রবিবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড সহ বিশ্বের একাধিক শহরের প্রতিবাদ, মানববন্ধন কর্মসূচি নেওয়া হয়।
এদিন ধর্মতলায় ডাক্তারদের প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দেন নির্যাতিতার বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যরা। সেখান থেকে মেয়ের মৃত্যুর বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সকল আন্দোলনকারীদের তাদের পরিবারের পাশে থাকার আর্জি জানিয়ে নির্যাতিতার বাবা জানান ‘এখন যে পরিস্থিতি আমি দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হয় আমরা অত সহজে বিচার পাব না। বিচার হয়তো আমাদের ছিনিয়ে আনতে হবে এবং সকলের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আশা করি সকলেই আমাকে সহযোগিতা করবেন।’ তিনি এও জানান ‘আজ আমার মেয়ে চলে গেছে, আমি খুবই শোকাহত। মেয়ের কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্ট করে মেয়েটা আজ এই জায়গায় পৌঁছায়। আমরাও মেয়ের জন্য কষ্ট করেছিলাম। কিন্তু একটা রাতেই আরজি করের দুর্বৃত্তরা আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়ে আমার গোটা পরিবারটাকে শেষ করে দিল।’
আবেগ তাড়িত গলায় নির্যাতিতার মা জানান ‘আমি কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমার মেয়ে যখন খুব ছোট ছিল, তখন থেকেই ওর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। সে বলেছিল আমি অনেক লোকের সেবা করবো। সেই সেবা করতে এসেই আমার মেয়েটা আরজি কর হাসপাতালে বলিদান হয়ে গেছে। কর্মরত অবস্থায় একজন ডাক্তারকে এভাবে নৃশংসভাবে অত্যাচারিত হয়। সে যখন মা মা করে কাঁদছিল সেই কান্নাটা রোজ আমার কানে বাজে। তখন ভাবি কত কষ্টে আমার মেয়ের প্রাণটা চলে গেছে। সরকার, পুলিশ প্রশাসন সবসময় আমাদেরকে অসহযোগিতা করে এসেছে। ওরা যদি একটু সহযোগিতা করতো তাহলে হয়তো একটু হলেও আশার আলো দেখতে পেতাম।’ ছাত্র-ছাত্রী ও আন্দোলনকারীদের কাছে মা’য়ের আবেদন ‘যতদিন না আমরা বিচার পাই, ততদিন আপনারা এভাবে আমাদের পাশে থাকবেন।’